স্ট্রোক আমাদের মস্তিষ্কের রক্তনালীতে এক ধরনের আকস্মিক বাধা, যা আমাদের জীবনকে চিরতরে বদলে দিতে পারে। কারণ, স্ট্রোক হলে মানুষের নড়াচড়া, কথা বলা, ভারসাম্য – সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু স্ট্রোক হলেই যে মানব জীবনের আশার আলো নিভে যাবে বিষয়টা এমন ফিজিওথেরাপি মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীরা ফিরে পায় সুস্থতা, রোগীরা উপভোগ করতে পারে স্বাধীন জীবন।
স্ট্রোক কি? | What is a stroke?
স্ট্রোক – শুধু একটি রোগ নয়, বরং মস্তিষ্কের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়। রক্তনালীর বাধায় মস্তিষ্কের কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, এরফলে কোষের মৃত্যু ঘটে। আর এই কোষের মৃত্যুর কারণে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। যেমন, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর নড়াচড়া, কথা বলা, ভারসাম্য, স্মৃতি – সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে।
তবে কেউ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ, স্ট্রোক একটি মারাত্মক রোগ হলেও, দ্রুত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে অনেক রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
স্ট্রোকের ধরন গুলো কি কি?
মানুষের মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে স্ট্রোক হয়। কারণ এটি মস্তিষ্কের কোষ গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত বা মেরে ফেলতে পারে। এছাড়াও শারীরের বিভিন্ন অংশে দীর্ঘস্থায়ী বা স্বল্পস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই স্ট্রোক কে মানব দেহের সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আর মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার স্ট্রোক এর প্রধানত দুইটি ধরন আছে। সেগুলো হলো,
- ইসকেমিক স্ট্রোক
- হেমোরেজিক স্ট্রোক
ইসকেমিক স্ট্রোক কি?
মস্তিষ্ক হলো আমাদের শরীরের সবচেয়ে জটিল একটি অঙ্গ। যা এক মুহুর্তের জন্যও রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে মারা যেতে পারে অসংখ্য কোষ। আর ইসকেমিক স্ট্রোক হচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরফলে মস্তিষ্কের কোষ গুলো অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে মারা যেতে শুরু করে। আর বর্তমান সময়ে অধিকাংশ রোগীরা ইসকেমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
হেমোরেজিক স্ট্রোক কি?
মস্তিষ্কের রক্তনালীতে দুর্বলতা, উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কের গিলিওমা, অ্যানিউরিজম, রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা – এসব কারণে হেমোরেজিক স্ট্রোক হতে পারে। আর হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে রোগীর হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, চেতনা হারানো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষন দেখা যায়।
স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণ
হঠাৎ অবশ হয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট বক্তৃতা, ঝাপসা দৃষ্টি – এগুলো কি স্ট্রোকের লক্ষণ? হ্যাঁ, স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। তাই দ্রুত চিকিৎসা না করলে স্ট্রোক মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বয়স কি স্ট্রোকের একমাত্র ঝুঁকি?
অনেকের ধারণা, বয়স বেড়ে গেলেই স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। হ্যাঁ, এটা সত্যি হলেও, ৫৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যেও স্ট্রোকের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যদিওবা পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম। তবে স্ট্রোকের কারণে মারা যাওয়া মহিলাদের সংখ্যা স্তন ক্যান্সারে মারা যাওয়া মহিলাদের চেয়ে অনেক বেশি।
ঝুঁকির কারণ গুলো কি কি?
- মাদকদ্রব্য সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকা স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যেমন অতিরিক্ত লবণ, চর্বি এবং চিনি গ্রহণ স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- অতিরিক্ত ওজন স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- উচ্চ কোলেস্টেরল স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- ডায়াবেটিস স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়।
মনে রাখবেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও যাদের পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস আছে তাদেরও স্ট্রোকের ঝুঁকির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
স্ট্রোক বোঝার উপায় কি? | স্ট্রোক এর লক্ষণ
হার্ট অ্যাটাকের মতো তীব্র বেদনা ছাড়াই স্ট্রোক আসে। যার ফলে অনেকেই স্ট্রোকের মারাত্মক বিপদ সংকেত বুঝতে পারেনা। তবে এমন কিছু লক্ষণ আছে যে গুলোর মাধ্যমে স্ট্রোক শনাক্ত করা সম্ভব। আর সেই লক্ষণ গুলো হলো,
- মুখ, বাহু বা পায়ের একদিক হঠাৎ অবশ বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
- হঠাৎ কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে, অথবা অন্যের কথা বুঝতে সমস্যা হতে পারে।
- একটি চোখ বা উভয় চোখে দেখতে সমস্যা হতে পারে।
- হঠাৎ হাঁটতে সমস্যা হতে পারে, ভারসাম্য হারাতে পারে অথবা মাথা ঘুরতে পারে।
- কোনো অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে।
এই লক্ষণ গুলো একজন ব্যক্তির মধ্যে দেখা যাওয়ার পর আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তুু ঠিক হলেই বসে থাকা যাবেনা বরং আপনাকে অতি দ্রুত অভিজ্ঞ ডক্টরের শরনাপন্ন হতে হবে।
স্ট্রোক রোগ নির্ণয়
স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। তাই দ্রুত চিকিৎসা না করলে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কিন্তু স্ট্রোক কিভাবে নির্ণয় করা হয়?- সে সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারনা রাখা দরকার।
আর স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ বা জরুরী ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। কারণ, ডাক্তার আপনার অবস্থা বুঝতে এবং স্ট্রোকের কারণ নির্ণয় করতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন।
স্ট্রোক রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা
- নিউরোলজিক পরীক্ষা: ডাক্তার আপনার শারীরিক ও স্নায়বিক পরীক্ষা করবেন।
- ব্রেন ইমেজিং: সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই স্ট্রোকের ধরন, অবস্থান এবং মাত্রা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
- রক্ত প্রবাহ পরীক্ষা: ক্যারোটিড এবং ট্রান্সক্রানিয়াল আল্ট্রাসাউন্ড এবং অ্যাঞ্জিওগ্রাফি রক্ত প্রবাহ এবং রক্তপাতের স্থানগুলো দেখায়।
- রক্ত পরীক্ষা: রক্তপাত বা জমাট বাঁধার ব্যাধি গুলোর জন্য পরীক্ষা করা হয়।
- ইকেজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃৎপিণ্ডের সমস্যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে, তাই এই পরীক্ষা গুলো করা হয়।
- মানসিক পরীক্ষা: স্ট্রোকের ফলে মানসিক ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই এই পরীক্ষা গুলো করা হয়।
এই পরীক্ষা গুলোর মাধ্যমে ডাক্তার স্ট্রোকের কারণ নির্ণয় করতে পারে। এর পাশাপাশি রোগীদের সুস্থতার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করে।
স্ট্রোকের চিকিৎসা
স্ট্রোকের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যখন কোনো ব্যক্তির মধ্যে স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা যাবে তখন যতোটা সম্ভব কম সময়ের মধ্যে রোগীকে অভিজ্ঞ ডক্টরের নিকট নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করবেন। স্ট্রোক হলে ভালো ফিজিওথেরাপিস্ট এর মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি নিলেসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । আর ডক্টররা যেসব চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর সুস্থতা প্রদান করে সেগুলো হলো,
মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বাধার কারণে স্ট্রোক হলে
- TPA (টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর: এটি একটি ক্লট-বাস্টিং ড্রাগ যা রক্তপাতহীন স্ট্রোক শুরু হওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
- রক্ত পাতলা করে এমন ওষুধ: যার মধ্যে অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট (ওয়ারফারিন) এবং অ্যান্টিপ্লেটলেট ওষুধ (অ্যাসপিরিন বা টিক্লোপিডিন) অ্যাসপিরিন এবং টেকসই রিলিজ ডিপাইরিডামলের সংমিশ্রণ।
- সার্জারি: ঘাড়ের সংকীর্ণ রক্তনালী গুলোর ভিতরের অংশ খুলে দেওয়া হয়।
রক্তপাতের কারণে স্ট্রোক হলে
- ওষুধঃ স্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা বজায় রাখে।
- সার্জারিঃ মস্তিষ্কে রক্ত অপসারণ বা মস্তিষ্কের উপর চাপ কমানো।
- ওষুধঃ মস্তিষ্কের ফোলা প্রতিরোধ করে।
- মস্তিষ্কের ফাঁপা অংশে চাপ কমাতে টিউব ঢোকানো।
স্ট্রোক রোগীর খাবার তালিকা
স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বাধা, শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, বরং মানসিকভাবেও একজন ব্যক্তিকে ভেঙে ফেলে। আর এই ভয়াবহতার পর, রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করতে পুষ্টির ভূমিকা অপরিসীম।
পুষ্টির চাহিদা, রোগীর অবস্থা অনুযায়ী
স্ট্রোকের ধরন এবং রোগীর অবস্থা অনুযায়ী পুষ্টির চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। স্বাভাবিক খাবার, সেমিসাইড খাবার, লিকুইড খাবার, এনজি (নলের মাধ্যমে) অথবা আইভি/টিপিপি – রোগীর জন্য কোন পদ্ধতিটি উপযুক্ত হবে তা ডাক্তাররা বুঝতে পারবেন।
প্রথম ১২ ঘণ্টা: পানির গুরুত্ব
স্ট্রোকের পর প্রথম ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর পানির চাহিদা পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
রোগীর বিশেষ খাদ্যতালিকা
- রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক: ভিটামিন কে–যুক্ত খাবার (সবুজ শাক, মসুর ডাল, ফুলকপি, ঢ্যাঁড়স, বাঁধাকপি) পরিহার করতে হবে।
- মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি: প্রোটিনের চাহিদা বাড়াতে হবে। দৈনিক দু–তিনটি ডিমের সাদা অংশ, চার থেকে পাঁচ টুকরো মাছ বা মাংস খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
- মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর কার্যক্ষমতা: ভিটামিন (বি কমপ্লেক্স) জাতীয় খাবার (ডিম, দুধ, মাংস, রঙিন শাকসবজি) গুরুত্বপূর্ণ।
- ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য: রক্তের পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপযোগী খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে।
- কোলেস্টেরল: কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রেখে চর্বি ও চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সপ্তাহে দুদিন সামুদ্রিক তৈলাক্ত মাছ খেতে হবে।
- ডায়াবেটিস: রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।
- কম খাবার খাওয়ার সমস্যা: কনসেনট্রেটেড ক্যালরিযুক্ত খাবার (খেজুর, বাদাম, কলা, অলিভ অয়েল, চিড়া, আলু, কিশমিশ, মধু) খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
আপনার জন্য আমাদের কিছুকথা
বর্তমান সময়ে স্ট্রোক একটি ভয়াবহ রোগে চিহ্নিত হয়েছে। তাই কোনো ব্যক্তির মধ্যে স্ট্রোকের লক্ষন দেখামাত্রই দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার চেস্টা করবেন। অন্যথায় স্ট্রোক আরো ভয়াবহ রুপ নিতে খুব বেশি সময় নিবেনা। তাই স্ট্রোক হলে সময়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিবেন।