ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রসারে সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই – সমকাল-বিপিএ গোলটেবিল বৈঠক

ফিজিওথেরাপি আধুনিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ও স্বতন্ত্র চিকিৎসা। শুধু পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিই নন; বাতের ব্যথা, প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি এবং অটিজম আক্রান্ত শিশু থেকে শুরু করে অনেক রোগীর চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির নানামাত্রিক ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজনের কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। তবে তাদের চিকিৎসার জন্য খুব বেশি সুযোগ এখনও নেই। এ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সর্বস্তরে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া এবং সব বিভাগীয় শহরে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ ছাড়া এ ধরনের চিকিৎসাসেবার প্রসারে সম্মিলিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রেফারেল পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস উপলক্ষে রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘স্বাস্থ্য ও রিহ্যাবিলিটেশন খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে সমকাল ও বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। সহযোগিতায় ছিল ঢাকা কলেজ অব ফিজিওথেরাপি (ডিসিপিটি), এএসপিসি ম্যানিপুলেশনথেরাপি এবং ময়মনসিংহ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেস।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন ডা. শাহরিয়ার নবী। সভাপতিত্ব করেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান; সঞ্চালনায় ছিলেন ময়মনসিংহ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেসের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য ড. শামীম আহাম্মদ।

 

 

এতে আলোচক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আলতাফ হোসেন সরকার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক ডা. ফিরোজ কবীর, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক ডা. সনজিত কুমার চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহাদাৎ হোসেন।

এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব খন্দকার মো. মুশফিকুর রহমান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সারওয়ার হোসেন এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ড. কাজী মো. এমরান হোসেন।

‘ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পেশা ও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. ফিরোজ কবীর। তিনি বলেন, এ দেশে আইন অনুযায়ী ‘ফিজিওথেরাপি কাউন্সিল’ চালু করা জরুরি। তিনি ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো- অতিসত্বর বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের কার্যক্রম চালুসহ একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া, রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলে আনুপাতিক হারে ফিজিওথেরাপিস্টদের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণসহ অংশীদার নয় এমন পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব বাতিল, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে টারশিয়ারি পর্যায়ে ফিজিওথেরাপিস্টদের জন্য প্রথম শ্রেণির পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির শূন্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের পিএসসির প্রথম শ্রেণির ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধী সাহায্য ও সেবাকেন্দ্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের নিয়োগপ্রাপ্ত পদগুলোকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি ‘বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি’ প্রতিষ্ঠা করা।

সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন সঠিক বাস্তবায়নে যা করা প্রয়োজন, তাই করা হবে। আমার পক্ষ থেকে কথা দিয়ে যাচ্ছি- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল কার্যকরে ব্যবস্থা নেব।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, স্বাভাবিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবাও প্রয়োজন। নিজেও এ চিকিৎসা নিয়ে কোনো ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হয়েছি। মেডিসিনের চিকিৎসক যেমন প্রয়োজন; সার্জারি চিকিৎসকও প্রয়োজন। একই সঙ্গে ফিজিওথেরাপির চিকিৎসক প্রয়োজন। এ জন্য চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, এখানে যারা পড়াশোনা করছে তাদের একটি স্বীকৃতি দরকার। এ জন্য নিবন্ধন প্রয়োজন। ২০১৮ সালে এ বিষয়ে আইন হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও এটি এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এখনও জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এটা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। আমরা পেশাগত জায়গায় এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে ঢুকতেই দিই না। আমাদের এ মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি বলেন, এক ছাদের নিচে যদি আমরা সব সেবা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এমন চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সেসব দেশে ফিজিওথেরাপিস্টদের চিকিৎসক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

ডা. শাহরিয়ার নবী বলেন, সর্বজনীনভাবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বাস্তবায়নে কোন জায়গায় বাধা রয়েছে, সে জায়গা খুঁজে বের করে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এটা হলো মৌলিক বিষয়। এটি করতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে।

অধ্যাপক আলতাফ হোসেন সরকার বলেন, ১৯৭৩ সালে যখন এ বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়, সে সময়ের সিলেবাস এবং প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশে পরিবর্তন হয়েছে। ফিজিওথেরাপি এখন আর আগের অবস্থানে নেই, বরং আরও ভালো অবস্থানে এসেছে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের দরজায় এ চিকিৎসা পৌঁছে গেছে।

ডা. সনজিত কুমার চক্রবর্তী বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব শাখায় ‘প্রি-অপারেটিভ’ এবং ‘পোস্ট-অপারেটিভ’ ফিজিওথেরাপি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিভিন্ন স্থানে দেখেছি, প্রতিটি সার্জারির ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই রোগীদের ফিজিওথেরাপি না দেওয়া হলে তাঁদের মধ্যে প্রতিবন্ধিত্ব চলে আসে। যেমন দেখা গেল- অস্ত্রোপচারের পর প্লাস্টার খোলার সময় রোগী সঠিক থেরাপি না পেলে তাঁর অস্থিগ্রন্থি বিকল হয়ে প্রতিবন্ধিত্ব দেখা দেবে। ফিজিওথেরাপির অভাবে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার পরও সঠিক ফল অনেকে পায় না। তাই চিকিৎসা পেশার সব শাখার সঙ্গে ফিজিওথেরাপিকে সমান্তরালভাবে নিয়ে আসতে হবে।

ডা. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন ২০০৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন অব ফিজিক্যাল থেরাপি’র (ডব্লিউসিপিটি) সদস্যপদ লাভ করে। তখন থেকেই ১৫ বছর ধরে আমরা ৮ সেপ্টেম্বরকে ‘বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস’ হিসেবে পালন করছি। ১২২টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালন করা হয়। চিকিৎসাক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিকে মূলধারায় নিয়ে আসাই আমাদের লক্ষ্য।

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবার একটি শাখা। এই শাখাকে চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে আলাদা করা যাবে না; একই সঙ্গে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব শাখার সঙ্গে ফিজিওথেরাপিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রসারে সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই

Share This :

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen + 6 =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Message Us on WhatsApp